স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের মহানায়কের জন্মদিন

 অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু:  বাঙালি জাতির কাছে অবিস্মরণীয় একটি দিন ১৭ মার্চ। কেননা, ১৯২০ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে মুক্তির প্রভাকর রূপে জন্ম নিয়েছিল একটি শিশু। ‘খোকা’ নামের সেই শিশুটি শিক্ষা-দীক্ষা, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী, সততা, সাহস, দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

 

জন্ম
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত আটটায় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ পরিবারের আদরের ‘খোকা’। তার পুরো নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মাতার নাম সায়েরা খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। বাবা-মা তাকে ডাকতেন ‘ খোকা’ বলে।

আর এই শিশুটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি। যিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির ‘মুজিব ভাই’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’। তার হাত ধরেই আসে বাঙালির স্বাধীনতা, জন্ম নেয় বাংলাদেশ। এভাবে তিনি হয়েছিলেন বাঙালি জাতির জনকও। তার নেতৃত্বে বাঙালির বহু বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙেছে। শুধু তাই নয়, তার সুদূরপ্রসারী বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ নামের নতুন একটি জাতিরাষ্ট্র।

 

বঙ্গবন্ধুর বাল্যজীবন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার চিরায়ত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি শিশুকাল থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজজীবনে তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজাপীড়ন দেখে চরমভাবে ব্যথিত হতেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সম্প্রীতির সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িক চেতনার।

 

রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু

কিশোর বয়সেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা। তিনি সারাজীবন এ দেশের মাটি ও মানুষের অধিকার আদায় ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করেছেন। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য জীবনের ১৪টি বছর পাকিস্তানি কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে বন্দী থেকেছেন, দুইবার ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু আত্মমর্যাদা ও বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কখনো মাথা নত করেননি, পরাভব মানেননি।

 

আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয়দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান পেরিয়ে ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। বঙ্গবন্ধুর সাহসী, দৃঢ়চেতা, আপসহীন নেতৃত্ব ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে জেগে ওঠে শত বছরের নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি। মুক্তির অদম্য স্পৃহায় উদ্বুদ্ধ করে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন।

 

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশজুড়ে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদ্বয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।

 

বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারাভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে।

 

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তার নেতৃত্বেই ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবের পৃষ্ঠপোষকতায় একঝাঁক মেধাবী তরুণের উদ্যোগে সেদিন যাত্রা শুরু করে ছাত্রলীগ। এরপরই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন, স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনা, গণতন্ত্র প্রগতির সংগ্রামকে বাস্তবে রূপদানের ইতিহাসে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সংগঠনটি।

 

সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু

স্বাধীনতার স্থপতি এই বীর নেতা একজন সফল রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। তার দূরদর্শী চিন্তা চেতনা এখনও আমাদের বিস্মিত করে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সুপরিকল্পিত। তিনি যে কতটা গভীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন হতে শুরু করে বাণিজ্যনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, স্বাস্থ্যনীতি, স্বরাষ্ট্রনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতেন সেসব বোঝার ক্ষমতা তখন সকলের ছিল না। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ পরিচালনায় তার প্রজ্ঞার পরিচয় আজ এত বছর পরও আমরা অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু কিছু বিপথগামী স্বার্থান্বেষী চক্র, দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধু তথা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার পাঁয়তারা করে। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বিশ্বাসঘাতকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। আজ জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের রোডম্যাপ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের ফসল।

 

বাংলাদেশের কালো অধ্যায়

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বিশ্বাসঘাতকদের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। পরবর্তী সময়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী বঙ্গবন্ধুর খুনি স্বৈরশাসক এ দেশে পাকিস্তানি ভাবধারার বিকৃত ইতিহাস ও মূল্যবোধের বিস্তার ঘটানোর পাঁয়তারা চালায়। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ তারই বড় কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমানে টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায়।

 

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ 

প্রসঙ্গত, বাংলা, বাঙালি, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। মুক্তিকামী মানুষের স্লোগানের নাম শেখ মুজিব। বাঙালি জাতির চেতনার ধমনীতে প্রবাহিত শুদ্ধতম নাম শেখ মুজিব। তিনি চিরন্তন-চিরঞ্জীব; বাঙালির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে অবিনাশী চেতনার নাম। তিনি বাঙালি জাতির কাছে স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের মহানায়ক।

 

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে স্মরণকালের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসভায় ভাষণ দেন। ঐতিহাসিক এই ভাষণটি তিনি বিকাল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকাল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। ১৮ মিনিট স্থায়ী হয় ভাষণটি। এই সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু প্রাণিত করে তোলেন লাখো বাঙালিকে, শানিত করেন বাঙালির সাহস। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে কত লক্ষ লোকের জমায়েত হয়েছিল তার প্রকৃত হিসাব করা যায়নি। শুধু সেই জনসভায় উপস্থিত বাঙালি নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ সেইদিন নতুন জীবনের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়। এই ভাষণ দিয়ে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথ রচনা করেছিলেন।

ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ দৃঢ়চিত্তে এমন সাহসী কথা বলার স্বজন, পরম আত্মীয় বাংলার মাটি ও মানুষের একজনই ছিলেন- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম শেষে বাঙালি জাতির পুনর্জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালে। এই পুনর্জন্মের স্বপ্নদ্রষ্টা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভ ও ‘৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ— নবজন্মের জোয়ারে বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই আত্মপরিচয় সম্পর্কে বাঙালিকে সচেতন ও সচেষ্ট করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

এই মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের যথার্থ উচ্চারণ : “যতদিন রবে পদ্মা- মেঘনা / গৌরী – যমুনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

 

মোটকথা, বঙ্গবন্ধুর কীর্তি ও অবদান বলে শেষ করার নয়। তার নাম বাংলার মাটিতে, বাংলার কথায় , বাঙালির জাতিস্বত্ত্বায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আজীবন।

লেখক : অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা ইমনকে গ্রেফতার

» গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরি: ৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা

» একদিনের ব্যবধানে কমল স্বর্ণের দাম

» নাগরিক কমিটিতে যুক্ত হলেন সারজিসসহ আরও ৪৫ জন

» সকল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা

» অহিংস গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মাহবুবুল আলম গ্রেপ্তার

» চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার: প্রতিবাদে ডিবির সামনে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ

» ডিবি হেফাজতে সনাতন জাগরণ মঞ্চের চিন্ময় কৃষ্ণ

» অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদশের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীন আটক

» ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের মহানায়কের জন্মদিন

 অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু:  বাঙালি জাতির কাছে অবিস্মরণীয় একটি দিন ১৭ মার্চ। কেননা, ১৯২০ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে মুক্তির প্রভাকর রূপে জন্ম নিয়েছিল একটি শিশু। ‘খোকা’ নামের সেই শিশুটি শিক্ষা-দীক্ষা, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী, সততা, সাহস, দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

 

জন্ম
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত আটটায় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ পরিবারের আদরের ‘খোকা’। তার পুরো নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মাতার নাম সায়েরা খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। বাবা-মা তাকে ডাকতেন ‘ খোকা’ বলে।

আর এই শিশুটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি। যিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির ‘মুজিব ভাই’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’। তার হাত ধরেই আসে বাঙালির স্বাধীনতা, জন্ম নেয় বাংলাদেশ। এভাবে তিনি হয়েছিলেন বাঙালি জাতির জনকও। তার নেতৃত্বে বাঙালির বহু বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙেছে। শুধু তাই নয়, তার সুদূরপ্রসারী বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ নামের নতুন একটি জাতিরাষ্ট্র।

 

বঙ্গবন্ধুর বাল্যজীবন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার চিরায়ত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি শিশুকাল থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজজীবনে তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজাপীড়ন দেখে চরমভাবে ব্যথিত হতেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সম্প্রীতির সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িক চেতনার।

 

রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু

কিশোর বয়সেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা। তিনি সারাজীবন এ দেশের মাটি ও মানুষের অধিকার আদায় ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করেছেন। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য জীবনের ১৪টি বছর পাকিস্তানি কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে বন্দী থেকেছেন, দুইবার ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু আত্মমর্যাদা ও বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কখনো মাথা নত করেননি, পরাভব মানেননি।

 

আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয়দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান পেরিয়ে ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। বঙ্গবন্ধুর সাহসী, দৃঢ়চেতা, আপসহীন নেতৃত্ব ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে জেগে ওঠে শত বছরের নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি। মুক্তির অদম্য স্পৃহায় উদ্বুদ্ধ করে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন।

 

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশজুড়ে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদ্বয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।

 

বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারাভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে।

 

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তার নেতৃত্বেই ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবের পৃষ্ঠপোষকতায় একঝাঁক মেধাবী তরুণের উদ্যোগে সেদিন যাত্রা শুরু করে ছাত্রলীগ। এরপরই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন, স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনা, গণতন্ত্র প্রগতির সংগ্রামকে বাস্তবে রূপদানের ইতিহাসে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সংগঠনটি।

 

সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু

স্বাধীনতার স্থপতি এই বীর নেতা একজন সফল রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। তার দূরদর্শী চিন্তা চেতনা এখনও আমাদের বিস্মিত করে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সুপরিকল্পিত। তিনি যে কতটা গভীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন হতে শুরু করে বাণিজ্যনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, স্বাস্থ্যনীতি, স্বরাষ্ট্রনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতেন সেসব বোঝার ক্ষমতা তখন সকলের ছিল না। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ পরিচালনায় তার প্রজ্ঞার পরিচয় আজ এত বছর পরও আমরা অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু কিছু বিপথগামী স্বার্থান্বেষী চক্র, দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধু তথা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার পাঁয়তারা করে। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বিশ্বাসঘাতকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। আজ জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের রোডম্যাপ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের ফসল।

 

বাংলাদেশের কালো অধ্যায়

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বিশ্বাসঘাতকদের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। পরবর্তী সময়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী বঙ্গবন্ধুর খুনি স্বৈরশাসক এ দেশে পাকিস্তানি ভাবধারার বিকৃত ইতিহাস ও মূল্যবোধের বিস্তার ঘটানোর পাঁয়তারা চালায়। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ তারই বড় কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমানে টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায়।

 

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ 

প্রসঙ্গত, বাংলা, বাঙালি, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। মুক্তিকামী মানুষের স্লোগানের নাম শেখ মুজিব। বাঙালি জাতির চেতনার ধমনীতে প্রবাহিত শুদ্ধতম নাম শেখ মুজিব। তিনি চিরন্তন-চিরঞ্জীব; বাঙালির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে অবিনাশী চেতনার নাম। তিনি বাঙালি জাতির কাছে স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের মহানায়ক।

 

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে স্মরণকালের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসভায় ভাষণ দেন। ঐতিহাসিক এই ভাষণটি তিনি বিকাল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকাল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। ১৮ মিনিট স্থায়ী হয় ভাষণটি। এই সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু প্রাণিত করে তোলেন লাখো বাঙালিকে, শানিত করেন বাঙালির সাহস। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে কত লক্ষ লোকের জমায়েত হয়েছিল তার প্রকৃত হিসাব করা যায়নি। শুধু সেই জনসভায় উপস্থিত বাঙালি নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ সেইদিন নতুন জীবনের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়। এই ভাষণ দিয়ে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথ রচনা করেছিলেন।

ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ দৃঢ়চিত্তে এমন সাহসী কথা বলার স্বজন, পরম আত্মীয় বাংলার মাটি ও মানুষের একজনই ছিলেন- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম শেষে বাঙালি জাতির পুনর্জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালে। এই পুনর্জন্মের স্বপ্নদ্রষ্টা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভ ও ‘৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ— নবজন্মের জোয়ারে বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই আত্মপরিচয় সম্পর্কে বাঙালিকে সচেতন ও সচেষ্ট করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

এই মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের যথার্থ উচ্চারণ : “যতদিন রবে পদ্মা- মেঘনা / গৌরী – যমুনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

 

মোটকথা, বঙ্গবন্ধুর কীর্তি ও অবদান বলে শেষ করার নয়। তার নাম বাংলার মাটিতে, বাংলার কথায় , বাঙালির জাতিস্বত্ত্বায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আজীবন।

লেখক : অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com